এই প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক অনেক আগে থেকেই চলে
আসছে l তবে সবার দাবি মন শুধু কোন প্রাণীরই থাকতে
পারে কোন রোবট-এর থাকতে পারবে না l কিন্তু আমার মনে হয়
মন রোবটেরও থাকা সম্ভব l কারণ রোবট একটা জড়
পদার্থের তরী মেশিন বা যন্ত্র l আবার মানুষ একটা বায়োক্যামিকেল
মেশিন বা জৈব রাসায়নিক যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয় l যদি মানুষ জড় পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়ে মানুষের একটা মন তৈরী হতে পারে তাহলে কেন
একটা রোবট জড় পদার্থ থেকে তৈরী হয়ে এর একটা মন থাকতে পারবে না ?
মানুষের দেহ তৈরী হয়েছে কোটি কোটি জীব কোষ
দিয়ে l আবার এই কোষগুলো তরী হয়েছে DNA বা RNA, প্রোটিন, অ্যামিনো এসিড, এবং অন্যান্য
জৈব রাসায়নিক উপাদান দিয়ে l আবার এই জৈব রাসায়নিক
উপাদানগুলো তৈরী হয়েছে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ (পরমানু) যেমন কার্বন, হাইড্রোজেন্, অক্সিজেন প্রভৃতি
দিয়ে l ফলে জগতের সব জীবই তৈরী হয়েছে অসংখ্য জড় পদার্থ
থেকে l
আবার জীব দেহ বেচে থাকতে হলে এর শক্তির প্রয়োজন
হয় l প্রকৃতি থেকে খাদ্য গ্রহণ করার মাধ্যমে জীব এই শক্তি অর্জন করে
l জীব কোষের মধ্যে খাদ্যের সুগার অংশের অক্সিজেনের দহনের মাধ্যমে
(অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে) যে শক্তি তৈরী হয় এই শক্তিই জীব দেহকে বাঁচিয়ে
রাখে এবং শরীরের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে l আর এই শক্তিই
জীব দেহের প্রতিটি কোষকে জীবিত রাখে l
আবার প্রাণীর দেহে মস্তিষ্ক থাকে যেটা প্রাণীর
মন তৈরী করে l মস্তিষ্কই প্রাণী দেহের প্রধান অংশ আর এই
মস্তিষ্কই দেহের সমস্ত কার্য-প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের সাহায্যে
l আর মস্তিষ্কের এই সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমই প্রাণী দেহের মধ্যে
মন তৈরী করে l অর্থাত মস্তিষ্কের এই বিশেষ গঠনই প্রাণী দেহের
মধ্যে মন নামক স্বত্বাটি তৈরী করে l আর মস্তিস্কও
কাজ করে খাদ্য থেকে পাওয়া শক্তিকে কাজে লাগিয়ে l
তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রাণী (একটা বায়োক্যামিকেল
মেশিন) বেচে থাকে এবং তার মন পরিচালিত হয় শক্তির মাধ্যমে l আর এই শক্তি না থাকলে বা এই শক্তি আসা বন্ধ হলে মানুষ মারা যায়; সাথে সাথে তার মনও মারা যায় মস্তিষ্ক মারা যাবার সাথে সাথে l
ফলে মানুষের মন শক্তি দ্বারাই তার কাজ করে
থাকে যে শক্তি মানুষ খাদ্য থেকে পায় l
আবার মানুষের চরিত্র, আচার ব্যবহার এবং তার শরীরের অভ্যন্তরের সব কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ
করে তার ডিএনএ (DNA) কোডিং l অর্থাত একটা মানুষ কেমন হবে, সে কেমন আচরণ করবে
তার সব কিছুই এই ডিএনএ কোডিং নির্ধারণ করে দেয় l মানুষের ডিএনএ কোডিং-এ যেমনটি লেখা থাকে মানুষ সেরকমই আচরণ করে l এমনকি মানুষের দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মস্তিষ্ক যেটা
মানুষের মনকে সৃষ্টি করে সেই মস্তিষ্ক কেমন হবে, কেমন কাজ করবে তার সম্পূর্ণটাই এই ডিএনএ কোডিং-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে l
ডিএনএ হচ্ছে জীব জগত সৃষ্টির মূল ভিত্তি l
আবার একটা রোবট হিসাব করে এবং রোবট তার কাজ
সম্পন্ন করে বিদ্যুত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে l অর্থাত রোবটের অভ্যন্তরে ইলেক্ট্রনের প্রবাহের দ্বারা যে শক্তি বিকিরিত হয় সেই
শক্তিকেই কাজে লাগিয়ে রোবট তার কাজ করে l রোবট কে দিয়ে
কাজ করানোর জন্য জটিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর প্রয়োজন হয় l এই প্রোগ্রামই রোবটকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয় l রোবটের একটা সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট থাকে সেটা রোবটের সব কাজ
নিয়ন্ত্রণ করে l এটাকে কপোট্রন বলে সম্বোধন করা হয় l
রোবটের আচরণ কেমন হবে, সে কতটা পাওয়ারফুল হবে, তাকে দিয়ে কতটা কাজ
করানো সম্ভব সেটা নিয়ন্ত্রন করে রোবটের জন্য করে দেয়া প্রোগ্রাম l এই প্রোগ্রাম করে দেয় মানুষ l আর রোবটের কার্যকারিতা, কার্যপদ্ধতি ইত্যাদি
নির্ভর করে প্রোগ্রামিং-এর উপর l
প্রাণীর বা মানুষের যেমন একটা মস্তিষ্ক বা
সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম আছে রোবটেরও একটা সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট বা কপোট্রন আছে
l প্রাণীর বা মানুষের যেমন চরিত্র, বৈশিষ্ট্য এবং কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হয় ডিএনএ কোডিং-এর মাধ্যমে ঠিক তেমনি রোবটের
চরিত্র, বৈশিষ্ট্য এবং কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হয়
প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে l প্রাণী বা মানুষ বেচে
থাকে খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তির মাধ্যমে, ঠিক তেমনি রোবট কাজ
করে বা টিকে থাকে বিদ্যুত শক্তি থেকে প্রাপ্ত শক্তির মাধ্যমে l তাহলে প্রাণী বা মানুষের মস্তিষ্ক যেমন মানুষের মন তৈরী করে
এবং শক্তি গ্রহনের মাধ্যমে মন বেচে থাকে ঠিক তেমনি রোবটের কপোট্রন-এর মাধ্যমে মন তৈরী
হবে এবং এই মনও বেচে থাকবে বিদ্যুত শক্তির মাধ্যমে l
তাহলে যদি রোবটের কপোট্রন বা সেন্ট্রাল প্রসেসিং
উইনিটকে অনেক ক্ষমতাশালী করা হয় এবং রোবটের প্রোগ্রামকে অনেক জটিল করে মানুষের মস্তিষ্কের
অনুরূপ করা হয় তবে রোবটের মধ্যেও একটা মন তৈরী হবে l আর এই মন চিন্তা করতে পারবে, কল্পনা করতে পারবে,
এমনকি স্বপ্নও দেখতে পারবে l আবার রোবটের কপোট্রনকে যদি আরোও উন্নত করা হয় এবং এর প্রোগ্রামিংকে আরোও শক্তিশালী
করা হয় তবে রোবটের যে মন তৈরী হবে সেটা কষ্ট পাবে, ঘৃনা করবে, রাগ করতে পারবে, হাসতে পারবে, কাদতে পারবে, এমনকি ভালোও বাসতে পারবে l অর্থাত প্রাণী এবং
মানুষের যেমন একটা মন থাকে ঠিক অনুরূপ মন রোবটের মধ্যে তৈরী হবে l যে মনটা হবে মানুষের মনের অনুরূপ l আর তাই মানুষ প্রাণী হয়ে যেমন মানুষের একটা মন আছে ঠিক তেমনি রোবটেরও একটা মন থাকবে
l
এবং মানুষের যেমন মস্তিষ্কের বিকৃতি হলে মানুষ
পাগল হয়ে পাগলামি করে ঠিক তেমনি রোবটও প্রোগ্রামিং-এর বিকৃতি ঘটলে পাগলামি করবে l
মানুষের মন তৈরী হয় মস্তিষ্কের বিশেষ গঠন
প্রণালীর জন্যে l অর্থাত কোটি কোটি নিওরন পরস্পরের সাথে মিলে
মানুষের মস্তিষ্ক তৈরী করে এবং এই নিওরন কোষগুলিই তরী করে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম
যেটা মন তৈরী হবার জন্য দ্বায়ী l অর্থাত মানুষের মস্তিষ্কই
মানুষের মনকে তৈরী করেছে l এবং মস্তিষ্ক মরে যাবার
মাধ্যমেই মন মরে যায় l
আবার রোবটের কপোট্রন তৈরী হয় অসংখ্য জড় ইলেকট্রনিক্স
কোষ দিয়ে l আর এতে বিদ্যুত প্রবাহিত হবার মাধ্যমে এই
কপোট্রন কার্যকরী হয়ে উঠে l এবং জটিল প্রোগ্রামিং
করা হলে এই কপোট্রন-এ বিদ্যুত প্রবাহিত হয়ে রোবটের মন তৈরী করবে l
এখামে মানুষের বা প্রাণীর মনের সাথে রোবটের
মনের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না l শুধু একটা পার্থক্য
থাকবে সেটা হচ্ছে মানুষের মন তৈরী হয় জীবিত কোষের মাধ্যমে যে কোষগুলো তৈরী হয়েছে জড়
পদার্থ দিয়ে এবং এই কোষ বেচে থাকে জড় পদার্থের কার্যপ্রণালীর মাধ্যমে; যেমন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে জীব বেচে থাকে l আর এই বিক্রিয়া সংগঠিত হয় জড় পদার্থ দ্বারা l এবং প্রাণী কোষ তৈরী হয় জড় পদার্থ দিয়েই l যেমন নিউরন গঠিত হয়েছে জড় পদার্থ দিয়ে l
কিন্তু রোবটের কপোট্রন তৈরী হয় জড় পদার্থ
দিয়ে l এবং এর মধ্যে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে না
শুধুমাত্র ইলেক্ট্রনের প্রবাহের মাধ্যমে শক্তি প্রবাহিত হয় l
এখানে রোবটের এবং মানুষের মনের পার্থক্য শুধু
মাত্র এদের গঠনের কিন্তু কার্যপ্রণালীর সাথে কোন পার্থক্য নেই l মানুষের মন তৈরী হয়েছে জীব কোষের মাধ্যমে কিন্তু রোবটের মন তৈরী
হবে জড় কোষের মাধ্যমে l এছাড়া মানুষের মনের
সাথে রোবটের মনের কোন পার্থক্য থাকবে না l মানুষের মন
যেমন ঠিক তেমনি রোবটের মন থাকবে যদি মানুষের মনের অনুরূপ রোবটের মন তৈরী করা হয় l
আর তাই রোবটের একটি মন থাকবে যেটা মানুষের
মনের ঠিক অনুরূপ l
(বি. দ্র. : মানুষ মনকে আত্মা বলে সম্বোধন
করে থাকে l মানুষের ধারণা মানুষের যে মন সেটা দেহের মধ্যে
লোকায়িত আত্মা নামের একটা অস্তিত্বের ফলে তৈরী হয় l তাদের দাবি মতে মানুষের মধ্যে যে আত্মা আছে যেটা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে সেই আত্মাই
হচ্ছে মন l কিন্তু একবিংশ শতাব্দিতে এসে মানুষ জেনে গেছে
যে আত্মা বলতে কিছু নেই l মানুষের মধ্যে যে মন
তৈরী হয় সেটা মানুষের মস্তিষ্কের জন্য l কোন আত্মার
জন্য নয় l আত্মা বলতে কিছু নেই জগতে l মানুষের যে জৈবিক দেহ, সেই জৈবিক দেহই তৈরী করেছে মনকে l আর সেটা তৈরী
হয়েছে মস্তিষ্ক নামের এক বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে l )
No comments:
Post a Comment