পৃথিবীর তাবৎ ধর্মের মতো খ্রিস্টানরাও নিজেদেরকে সত্য ধর্মের অনুসারী মনে করে। আর তারা এটাও বলে যে, যারা খ্রিস্ট ধর্ম
ছাড়া অন্য ধর্মকে অনুসরণ করে তারা সরাসরি নরকে যাবে এবং অনন্তকাল ধরে নরকের যন্ত্রনা
(অত্যাচার) সহ্য করবে। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্তের নাম বাইবেল। খ্রিস্টানদের দাবী এতে তাদের সৃষ্টিকর্তার
(জেহোবা অথবা ফাদার, সান ও হোলি স্পিরিটের ট্রিনিটি গড) বানী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাইবেলের কথা বা ধারণাগুলো
স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। বাইবেল দুই খন্ডে বিভক্ত। পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট হলো মুজেস
(ইহুদী নবী ও মুসলমানদের নবী মুসা) এর উপর আবর্তিত ওহী গ্রন্থ (যাকে 'তৌরাত'ও বলা হয়)। এবং নতুন নিয়ম বা নিউ টেস্টামেন্ট জেসাস ক্রাইস্টের (মুসলমানদের ঈসা নবীর) উপর
আবির্ভুত ঔহী গ্রন্থ (যাকে ইঞ্জীল শরীফও
বলা হয়)।
বাইবেল যদি সৃষ্টিকর্তার বানী সংকলন হয়ে থাকে তবে অবশ্যই বাইবেলের বাণী বা কথাগুলো
হবে সত্য ও বাস্তবসম্মত। যদি বাইবেলের কথাগুলো ভুল ও পরস্পর বিরোধী হয় তবে এটা সর্বজ্ঞানী
সৃষ্টিকর্তার বানী হবে না।
এই পর্বগুলোতে বাইবেলকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করা হবে। এবং বাইবেলের যাবতীয়
ভূল ও পরস্পর বিরোধীতাগুলো উপস্থাপন করা হবে।
শুরু করা যাক পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর প্রথম পুস্তক জেনেসিস থেকে।
পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর প্রথম পুস্তক হলো জেনেসিস বা বিশ্বজগতের সৃষ্টি। এটি প্রথমে আলাদা পুস্তক
আকারে ছিল এবং পরে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের প্রথম পুস্তক হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
পুস্তক জেনেসিস (সৃষ্টির বিবরণ), অধ্যায় ১
১.১
আদিতে (প্রথমে বা শুরুতে) ঈশ্বর আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন।
আলোচনাঃ বাইবেলের পুরাতন নিয়মের প্রথম পুস্তক জেনেসিসের প্রথম বাক্যটিই ভূল। এখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর
শুরুতেই অর্থাৎ প্রথমেই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের বলে যে পৃথিবী সৃষ্টি
হয়েছে বিশ্বজগত সৃষ্টির প্রায় ৯.৫ বিলিয়ন বছর পরে। প্রথমে বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে; বিশ্বজগত সৃষ্টির পর
এটির সব উপাদান ছিল শক্তি (এনার্জি) রুপে এবং এটি সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে আলো, তাপ এ অন্যান্য শক্তিগুলো
পরিবর্তিত হয়ে ইলেক্ট্রন, প্রোটনের মত অতি ক্ষুদ্র কণিকাগুলো তৈরি করেছে। এবং তারপর হাইডোজেনের
মত পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে। পরে এই হাইড্রোজেনগুলো একত্রিত হয়ে তৈরী করেছে তারকাগুলো। এবং পর্যায়ক্রমে হিলিয়াম, কার্বন ও অক্সিজেনের
মত পদার্থ তৈরী হয়েছে। এবং সব শেষে এসব পদার্থ মিলিত হয়ে গ্রহ, উপগ্রহ তৈরী কয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীর মতো গ্রহ তৈরী হয়েছে সব শেষে।
কিন্তু বাইবেল বলছে পৃথিবী শুরুতেই সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ বাইবেলের প্রথম বাণীই ভুল। এবং রীতিমত হাস্যকর।
১.২
পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল। এবং ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিত (ভেসে)
ছিল।
অর্থাৎ পৃথিবী তখনও পুরোপুরি তৈরী হয়নি এবং পৃথিবীতে কিছুই ছিল না বা শুন্য ছিল। সব কিছুকেই অন্ধকার
ঢেকে রেখেছিল বা জলের উপর অন্ধকার বিরাজ করছিল। আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
আলোচনাঃ শুরুতে পৃথিবীকে যখন তৈরী করা হয়েছিল তখনও এটা পুরোপুরি তৈরি হয়ে উঠেনি। এবং পৃথিবীতে কোন
কিছুই ছিল না। চারদিক শুধু অন্ধকার ছিল অর্থাৎ আলো ছিল না কোথাও। তখন ঈশ্বরের (সৃষ্টিকর্তার) আত্মা পানির উপরে
ভেসে ছিল।
এই বাক্যটিতে বা ভার্সটিতে কয়েকটি ভুল রয়েছে। যখন পৃথিবী তৈরীই হয়নি তার আগেই আলো বিরাজমান
ছিল। কারণ বিশ্বজগত তৈরীর
পর পরই আলো তৈরী হয়েছে। যখন পৃথিবী পুরোপুরি তৈরীই হয়নি তখন পানিও তৈরী হয়নি। আবার অন্ধকারের নিজের
কোন অস্তিত্ত্ব নেই তাই এটি কোন কিছুকে আবুত করতে পারবে না বা এটি কোন কিছুর উপর
থাকতে পারবে না। অন্ধকারের কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এটি প্রাণির চোখে আলোর অনুপস্থিতির জন্য মস্তিষ্কে সংঘটিত
একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র। অর্থাৎ আলোর অনুপস্থিতিতে মস্তিষ্কে যে কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি
ফুটে উঠে সেটিই অন্ধকার। ফলে যখন কোন প্রাণী তৈরীই হয়নি (কারণ সৃষ্টির শুরুতে কোন প্রাণি
তৈরী হয়নি) তখন অন্ধকারকে কেউ পর্যবেক্ষন করতে পারবে না। কারণ যেহেতু অন্ধকারের কোন অস্তিত্ব নেই
এবং কোন প্রানী না থাকলে অন্ধকারকে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না তাই সৃষ্টির শুরুতে
অন্ধকারও থাকবে না।
আবার বলা হয়েছে, ঈশ্বরের আত্মা পানির উপরে ভেসে বেড়াচ্ছিল, তাহলে বিশ্বজগতের সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টিকর্তা আসলে আত্মা হিসেবে
বিরাজমান ছিল। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের বলে যে আত্মা বলে কিছু নেই। প্রাণী দেহে আত্মার কোন স্থান নেই। ফলে ঈশ্বরের আত্মার
ধারণা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটি ভেবে দেখার বিষয়। আর ঈশ্বরের আত্মা কেন পানির উপর ভেসে বেড়াচ্ছিল
সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।
বিজ্ঞানের ভাষায় বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বে কোন স্থান বা জায়গা (স্পেস) ছিল না। বিশ্বজগত এক বিন্দুতে
মিলিত ছিল। সেই বিন্দুটিতেই বিশ্বজগতের সব কিছু, স্থান (স্পেস), সময় এবং উপাদান একত্রিত ছিল। ফলে বিশ্বজগতের কোন অতীত ছিল না; ছিল না কোন অতীত জায়গা। তাহলে বাইবেলের কথা
অনুযায়ী বলতে হয় বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টিকর্তা কোথায় ছিল এবং কি অবস্থায় ছিল
? যেহেতু সৃষ্টিকর্তাকে
জলের উপরে ভেসে থাকতে দেখা যাচ্ছে (বাইবেলে) তাহলে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার আত্মাকে কোন
না কোন জায়গায় অবস্থান করতে হয়। তো বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর তথা সৃষ্টিকর্তা কোথায় অবস্থান
করছিল? নাকি বিশ্বজগত সৃষ্টির
সাথে সাথেই সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে বলতেই হয় ঈশ্বর মানুষ ও বিশ্বজগতের মতই কোন এক সৃষ্টি।
১.৩
পরে ঈশ্বর বললেন, আলো হউক, তাতে আলো হলো।
অর্থাৎ ঈশ্বর শুধু মুখে বললেন, আলো হও, অমনি আলো সৃষ্টি হয়ে গেলো।
আলোচনাঃ ঈশ্বর বললেই কি সব কিছু সৃষ্টি হয়ে যায়? (হাহলে সে পৃথিবী থেকে
সব দুঃখ কষ্ট দুর করছেন না কেন ?
তিনি বললেইতো সব কষ্ট
দুর হয়ে যেতো !) ঈশ্বর বললো আলো ফুটুক অমনি আলো তৈরী হয়ে গেলো। ঈশ্বর বলাতেই যদি সব
কিছু তৈরী হয়ে যায় তবে তারতো কোন কাজেরই প্রয়োজন হয় না। শুধু বলবে অমনি সেটা হয়ে যাবে। বড়ই অদ্ভুত পদ্ধতি।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাইবেল অনুযায়ী শুরুতে পৃথিবী তৈরী করা হয়েছে এবং তারপরে আলো
তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে আলো তৈরী হবার অনেক পরে (বিলিয়ন বছর পরে) পৃথিবী তৈরী হয়েছে। অর্থাৎ বাইবেল মিথ্যে
কথা বলছে।
১.৪
তখন ঈশ্বর দেখলেন আলো ভালো, এবং অন্ধকার হতে আলোকে পৃথক করলেন।
আলোচনাঃ ঈশ্বর দেখলেন আলো উত্তম, কথাটির মানে কি? ঈশ্বর কি তবে এর পূর্বে আলো দেখেনি? যদি সে ইতিপূর্বে আলো
দেখে না থাকে তবে সে সর্বজ্ঞানী বা সর্বজ্ঞ নয়।
অন্ধকার থেকে আরোকে পৃথক করা যায় না। কারণ অন্ধকারের কোন অস্তিত্ব নেই। যার কোন অস্তিত্বই নেই তার থেকে কোন অস্তিত্বশীল
কিছুকে পৃথক করা যায় না। আর তাই অন্ধকার থেকে আলোকে পৃথক করা যাবে না। ফলে ঈশ্বর আলোকে অন্ধকার
থেকে পৃথক করেছেন কথাটি অজ্ঞতাপূর্ন। যখন আলোকে তৈরী করা হবে তখন এমনিতেই আলো ও অন্ধকার পৃথক হয়ে
উঠবে। আলাদা করে তাদেরকে
পৃথক করার দরকার নেই। বুঝাই যাচ্ছে বাইবেল লেখকের আলো আধারের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা নেই। অর্থাৎ বাইবেলের এই
কথাগুলো কোন সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আসেনি; এগুলো কোন অজ্ঞ মানুষ লিখেছে।
১.৫
এবং ঈশ্বর আলোর নাম দিলেন দিন ও অন্ধকারের নাম দিলেন রাত। এবং সন্ধ্যা ও সকাল
হলে প্রথম দিন সম্পন্ন হলো।
আলোচনাঃ আমার কাছে এই কথাটিতে (ভার্সটিতে) অনেক ভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে। প্রথমত, ঈশ্বর আলোর নাম দিলেন
দিন এবং অন্ধকারের নাম দিলেন রাত। এখানে অন্ধকারকে রাত বলাতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু আলোকে দিন
বলাতে সমস্যা আছে। কারণ সব আলোই দিন নয়। অনেক দুরের তারকা থেকে যে আলো আসে সেটা দিন তৈরি করতে পারে
না। আবার রেডিয়ামের মত
পদার্থ থেকে যে আলো বের হয় সেটাও দিন তৈরী করতে পারে না। আলো হলেই যে দিন হবে এমন কোন কথা নেই। কারণ রাতের বেলাতেও
পৃথিবীতে অনেক আলো থাকে কিন্তু সেগুলো দিন তৈরি করতে পারে না। কারণ দিন তৈরি করার
জন্য যে পরিমান আলোর প্রয়োজন সেটা সব আলোতে থাকে না। তারকার নিকটে অর্থাৎ যেখানে প্রচুর আলো আছে
সেখানেই দিন তৈরি হতে পারে।
ফলে ঈশ্বরের আলোকে দিন নাম দেওয়াটা ভ্রান্তিপূর্ণ। কিন্তু অন্ধকারকে রাত নাম দেওয়া যায়। যদিও রাত হতে হলে আলোর
অনুপস্থিতি হতে হয় অনেক বেশী। কিন্তু আলোকে দিন নাম দেওয়া যাবে না, কারণ দিন হতে হলে আলোর
উপস্থিতির পরিমান হতে হবে অনেক বেশী।
অর্থাৎ ঈশ্বরের আলোকে দিন নাম দেওয়া সঠিক নয়। কারণ তাতে জোনাকি পোকার আলোকেও দিন বলতে
হবে। অথবা কুপির আলোকেও
দিন বলতে হবে। না হলে পূর্ণিমার রাতকেও দিন বলে সম্বোধন করতে হবে।
দেখাই যাচ্ছে ঈশ্বরের দেওয়া দিন নামটিতে অনেক সমস্যা আছে।
আবার ঈশ্বর যদি আলোকে দিন নামই দিবেন তবে সেটাকে প্রথমে আলো বলে ডাকার মানেটা
কি থাকলো?
বাইবেলের বর্ননা খুব হাস্যকর!
এই কথা বা ভার্সটির পরের অংশটি আরো বেশী গোলমেলে। কারণ বলা হচ্ছে আলো হবার পরে দিন হলো এবং
রাত হলো। তারপর সন্ধা হয়ে পরের দিন সকাল হলে একদিন সম্পন্ন হলো। কিন্তু কথা হলো এই দিন রাত হওয়া এবং সন্ধ্যা
সকাল হওয়া কি বিশ্বজগতের সব জায়গায়ই সমান? বাইবেলে এ সম্মন্ধে কিছুই উল্লেখ নেই। তাতে বুঝা যাচ্ছে এখানে প্রথম দিন পৃথিবীতেই
হলো। কারণ যখন পৃথিবীতে
দিন হবে তখন বিশ্বজগতের সব জায়গায় দিন হবে না। আবার তেমনি ভাবে পৃথিবীতে যখন রাত হবে তখন
বিশ্বজগতের সব জায়গায় রাত হবে না। এবং বিশ্বজগতের এমন কিছু জায়গা থাকবে যেখানে সব সময়ই রাত অথবা
সব সময়ই দিন থাকবে। যেমন সৌরজগতের সূর্যের নিকটে কোন এক (শুন্য) জায়গায় সব সময়ই দিন থাকবে। আবার সৌরজগতের বাইরের
দিকে যেখানে সূর্যের আলো অনুপস্থিত বা আলোর আধিক্য অত্যন্ত কম সেখানে সব সময় রাত
হবে। ফলে রাত দিনের এই হিসেবটা
বিশ্বজগতের সব জায়গায় এক রকম হবে না। এবং ঈশ্বরের দিন রাতের নাম দেওয়াটাও বিশ্বজগতের সব জায়গার ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য হবে না। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে ঈশ্বর এখানে পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রথম দিন হওয়াকে বুঝিয়েছেন।
কিন্তু তখন কেবল মাত্র পৃথিবী তৈরি হয়েছে বাইবেলের কথা অনুযায়ী। কিন্তু বাইবেল অনুযায়ী
তখনও সূর্য তৈরি হয়নি। আর যদি সূর্য তৈরি নাই হয়ে থাকে তবে দিন রাত হবে কি করে? কারণ দিন হলো সূর্যের
আলোর উপস্থিতি আর রাত হলো সূর্যের আলোর অনুপস্থিতি। কিন্তু তখনও সূর্য তৈরীই হয়নি ফলে প্রথম দিন
হওয়াও সম্ভব নয়।
দিন হলো কোন তারকার নিকটে অবস্থিত কোন গ্রহ বা পদার্থের উপর আলোর উপস্থিতি। আর রাত হলো কোন তারকার
নিকটে অবস্থিত কোন পদার্থ বা গ্রহে আলোর অনুপস্থিতি। এখানে উল্লেখ্য বিশ্বজগতের যেকোন স্থান যেখানে
কোন প্রকার আলোই উপস্থিত থাকে না সেখানেই রাত হয়। কিন্তু আমরা রাত বলতে দিনের উপস্থিতিকে বুঝি
বলে রাতকে উপস্থিত বুঝতে হলে সেখানে দিন থাকতে হবে। আর তাই রাত দিনের হিসেব অনুযায়ী দিনের অনুপস্থিতি
হলো রাত। ফলে বিশ্বজগতের যেসব জায়গায় আলো নেই সে সব জায়গাতে রাত হলেও সেটাকে রাত বলা হয়
না। সেটাকে বলা হয় অন্ধকার। কারণ আমরা রাত বলতে
দিনের অনুপস্থিতিকে বুঝি। অর্থাৎ যেখানে দিনের উপস্থিতি থাকে কিন্তু যে সময়টাতে থাকে না
সেটাকেই রাত বলে।
কিন্তু বাইবেলে বলা হচ্ছে ঈশ্বর আলোকে দিন এবং অন্ধকারকে রাত নাম দিয়েছেন এবং
সন্ধ্যা ও সকাল হলে প্রথম দিন সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ এখানে পৃথিবীর হিসেবে প্রথম দিন বুঝানো
হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বাইবেল
অনুযায়ী তখনও সূর্য তৈরি হয়নি তাই প্রথম দিন হওয়াও সম্ভব নয়। অর্থাৎ এখানে পৃথিবী তৈরীর প্রথম দিকেই প্রথম
দিন সম্পন্ন হযেছে বলে যে দাবী করা হয়েছে সেটি সত্য নয়। কারণ প্রথম দিন হবার জন্য দরকার রাত দিনের
পরিবর্তন,
আর এই রাত দিনের পরিবর্তনে
প্রয়োজন সূর্য এবং পৃথিবীর আহ্নিক গতির। কিন্তু যেহেতু তখনও পৃথিবী পুরোপুরি তৈরি হয়নি এবং সূর্যও ছিল
না তাই প্রথম দিন হওয়াও সম্ভব নয়। অর্থাৎ বাইবেলের দাবী সম্পূর্ন ভিত্তিহীন।
১.৬
এবং বললেন, জলকে পৃথক করার জন্য জলের মধ্যে আকাশমন্ডলী তৈরি হোক!
১.৭
এবং ঈশ্বর আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করে উপরের জলকে নিচের জল থেকে পৃথক করলেন। (এক ভাগ জল আকাশমন্ডলের
উপরে এবং আরেক ভাগ জল আকাশমন্ডলীর নিচে থাকলো।) এবং এরকমই হলো।
১.৮
এবং ঈশ্বর আকাশমন্ডলীর নাম দিলেন আকাশ। এবং সন্ধ্যা ও সকাল হলে দ্বিতীয় দিন সম্পন্ন হল।
আলোচনাঃ এই কথা বা ভার্সগুলোতে অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে, যার সাথে বাস্তবতার
কোন মিলই নেই। জলকে পৃথক করার জন্য আকাশমন্ডলী তৈরী করা হলো এবং জল মাঝ বরাবর পৃথক হয়ে কিছু
জল থাকলো আকাশমন্ডলির উপর আর কিছু জল থাকলো আকাশের নিচে। এবং ঈশ্বর এই আকাশমন্ডলের নাম দিলেন আকাশ। ফলে আকাশের উপরেও পানি
থাকলো এবং আকাশের নিচেও পানি থাকলো।
আকাশের এরকম অদ্ভুত বর্ণনা শুধুমাত্র বাচ্চারা দিতে পারে। বুঝাই যাচ্ছে বাইবেলের এই অংশটুকু লিখেছে
প্রাচীণ কোন অজ্ঞ মানুষ। ফলে আকাশ তৈরীর অদ্ভুত বর্ণনা দিয়েছে। কারণ আকাশের নিচে জল থাকলেও আকাশের উপরে কোন
জল নেই। কারণ আকাশ কোন কঠিন পদার্থের তৈরী কোন শক্ত পানির পাত্রের মত নয়। আকাশ হলো বায়ুবীয়
পদার্থ। যেটা বাইবেল লেখক জানতো না বলে এমন অদ্ভুত কথা বলেছে।
এই অদ্ভুত অংশটুকু যে লিখেছে সে হয়তো ধরেই নিয়েছে যে, যেহেতু আকাশ থেকে বৃষ্টি হয় তাই আকাশের উপরে
নিশ্চয়ই পানি মজুত আছে এবং সময় বুঝে সেই পানি থেকে বৃষ্টি পড়ে। তাই এরকম বাস্তবতা
বহির্ভুত কথা লিখেছে বাইবেলে। একেবারে বাচ্চাশোলভ বর্ণনা। এবং আকাশ সৃষ্টির অদ্ভুত এবং হাস্যকর হাইপোথিসিস
বা অনুকল্প।
দ্বিতীয় দিন চলে গেল শুধু আকাশ তৈরিতে। ঈশ্বর খুব একটা কাজের লোক নয়। তার এত ক্ষমতা দিয়েও দুই দিনে আলো আর আকাশ
তৈরীতেই ব্যয় হয়ে যায়।
১.৯
এবং ঈশ্বর বললেন, আকাশের নিচের জল এক জায়গায় একত্রিত হোক এবং স্থলভাগ প্রকাশ হোক। এবং সেরকমই হলো।
১.১০
ঈশ্বর স্থলভাগের নাম দিলেন ভুমি, এবং জলরাশির নাম দিলেন সমুদ্র। এবং ঈশ্বর এই ব্যবস্থাকে উত্তম দেখলেন।
আলোচনাঃ আকাশের নিচের জল একত্রিত হলো এবং স্থলভাগ জাগ্রত হলো। ঈশ্বর স্থল ভাগের নাম
দিলো ভুমি এবং জলভাগকে নাম দিলো সাগর। অর্থাৎ সাগর এবং ভুমি এই নাম দুটো স্বয়ং ঈশ্বরের দেওয়া।
একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক। প্রথমে ঈশ্বর আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন এবং আকাশ ও পৃথিবী
পানি দ্বারা পূর্ণ ছিল। এমনকি ঈশ্বরের আত্মা সেই পানির উপরে ভেসে বেড়াতো। ইশ্বর আলো তৈরি করে আলো ও অন্ধকারকে পৃথক
করে দিন ও রাত তৈরি করলেন। এভাবে একদিন পূর্ণ হলো। পরে ঈশ্বর পানির মাঝ বরাবর ভাগ করে আকাশকে
উপরে উঠালেন এবং কিছু পানি আকাশের উপরে থাকলো
এবং বাকী পানি আকাশের নিচে থাকলো। এভাবে দ্বিতীয় দিন পার হলো। পরে ঈশ্বর আকাশের নিচের পানিকে একত্রিত করে
সমুদ্র তৈরি করলেন এবং এতে স্থলভাগ জেগে উঠে ভুমি হলো। এভাবেই পৃথিবী ও আকাশ তৈরী হলো। এবং ঈশ্বর এটাকেই উত্তম
দেখলেন।
ভুমি,
সমুদ্র ও আকাশ তৈরির
অদ্ভুত বর্ণনা। বলা বাহুল্য, এর সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। কারণ বিশ্বজগত সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী তৈরী হয়নি। একই ভাবে পানি পৃথিবীর
প্রারম্ভেই ছিল এবং ঈশ্বরের আত্মা সেই পানির উপরে ভেসে ছিল, এটি মোটেই বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য নয়। কারণ পৃথিবী তৈরী হবার অনেক পরে পৃথিবী শীতল
হয়ে তারপর পানি তৈরী হয়েছে। কিন্তু বাইবেল মতে পানি পৃথিবী ও আকাশ তৈরী হবার আগে থেকেই ছিল। আবার পানির মধ্যখানে
আকাশমন্ডলী সৃষ্টি হয়েছে এবং তারপর সেই আকাশ উপরের দিকে উঠে গিয়ে পানিকে দুই ভাগ করে
ফেলে, একভাগ আকাশের উপরে
থাকে, আরেক ভাগ আকাশের নিচে
পৃথিবীতে থেকে যায়। আকাশ তৈরীর এই পদ্ধতি বাস্তব আকাশ তৈরির সাথে সাংঘর্ষিক।
ঈশ্বর সব কিছু বললেই হয়ে যাচ্ছে পটাপট। শুধু বলা দেরি মাত্র, হতে দেরী নেই। আবার ঈশ্বর স্থলভাগের নাম ভুমি দিয়ে জলভাগের নাম সাগর দিলেন। এবং তারপর ঈশ্বর দেখলেন
যে এটি ভালো হয়েছে। তাহলে কী স্থল আর জলের নাম দেবার আগে ব্যবস্থাটা কেমন হবে সেটা ঈশ্বর জানতো না? তাহলেতো সে সব জান্তা
নয়; সে সর্বজ্ঞাতাও নয়।
১.১১
তখন ঈশ্বর বললেন, “পৃথিবীতে ঘাস হোক, শস্যদায়ী গাছ ও ফলের গাছপালা হোক| ফলের গাছগুলিতে ফল আর ফলের ভেতরে বীজ হোক| প্রত্যেক উদ্ভিদ আপন
আপন জাতের বীজ সৃষ্টি করুক| এইসব গাছপালা পৃথিবীতে বেড়ে উঠুক|” আর তাই-ই হল|
১.১২
পৃথিবীতে ঘাস আর শস্যদায়ী উদ্ভিদ উত্পন্ন হল| আবার ফলদায়ী গাছপালাও হল, ফলের ভেতরে বীজ হল| প্রত্যেক উদ্ভিদ আপন আপন জাতের বীজ সৃষ্টি করল এবং ঈশ্বর দেখলেন
ব্যবস্থাটা ভাল হয়েছে|
১.১৩
সন্ধ্যা হল এবং সকাল হল| এভাবে হল তৃতীয় দিন|
আলোচনাঃ ঈশ্বর শুধু বললো, পৃথিবীতে ঘাস, শস্যদায়ী গাছ ও ফলের গাছপালা হোক। ফলের গাছগুলোতে ফল হোক এবং প্রত্যেক উদ্ভিদ
নিজ নিজ জাতের বীজ সৃষ্টি করুক। ঈশ্বর বলা মাত্রই এসব হয়ে গেলো। ঈশ্বর দেখলেন এসব কিছুই চমৎকার হয়েছে। কেন ঈশ্বর কি তবে আগে
থেকে পরিকল্পনা করে এসব তৈরী করেননি? তাহলে সব কিছুকে কেন তিনি হয়ে যাবার পর ভালো দেখছেন? ঈশ্বর না সর্বজ্ঞানী, তাহলে সে আগে থেকে
জানতো না কেন যে এসব ভালো হবে? সে কী তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্বজগত তৈরী করেনি ?
ঈশ্বর এতো ক্ষমতাবান যে বলা মাত্রই সব কিছু নিজে নিজেই হতে থাকে বা সৃষ্টি হয়ে
যায়। কিন্তু এতো ক্ষমতা
নিয়েও ঈশ্বর মাত্র পৃথিবী, আকাশ, শুকনো ভুমি ও সাগর তৈরি করতেই এবং স্থলভাগে গাছপালা তৈরী করতেই
তৃতীয় দিন চলে যায়। আল্লাহ একটু অলস প্রকৃতির বলে মনে হচ্ছে। না হলে সে তিন দিনে মাত্র পৃথিবী আর আকাশ
ও গাছপালা তৈরী করতেই ব্যয় করে দেয়? সে তাহলে কিসের সর্বশক্তিমান !
ঈশ্বর গাছপালা তৈরী করে ফেললো কিন্তু সূর্য বাবাজির দেখা নেই; তাহলে গাছপালা বেঁচে
থাকলো কি করে? সূর্যের আলো ছাড়াতো গাছপারা খাদ্য তৈরী করতে পারে না বলে বেঁচে থাকতে পারে না।
এক্ষেত্রে খ্রিস্টানরা মুখ বাকা করে বলতে পারেন, ঈশ্বর চাইলে সবই সম্ভব। তিনি কুমারীকেও সন্তার দান করতে পারে!
সৃষ্টির এমন হাস্যকর কথাগুলো বাচ্চাকাচ্চাদের রাতে শুবার সময় বলা গালগপ্প ছাড়া
আর কিছুই না।
পৃথিবীর সব ধর্মের মতই বাইবেল সবাইকে হাসির খোরাক জোগাবে।
No comments:
Post a Comment