আস্তিকদের দাবী ধর্মই নৈতিকতার উৎস এবং ধর্মই নৈতিকতার ধারক এবং বাহক। তাদের বিশ্বাস যদি ধর্ম না থাকতো তবে মানুষের কোন নৈতিকতা বোধই থাকতো না। ধর্মের মাধ্যমেই মানুষ নৈতিকতার জ্ঞান লাভ করেছে এমনটিই বিশ্বাস করেন আস্তিকরা। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম না থাকলেও যে মানুষ নৈতিক হতে পারে এটা কিছুতেই তারা বুঝতে পারেন না। তাদের কাছে ধর্মই নৈতিকতা ঠিক করে দেয়। ধর্ম ছাড়া নৈতিকতা থাকা অসম্ভব বলেই আস্তিকরা বিশ্বাস করেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কি ধর্ম নৈতিকতার উৎস বা ধর্মই নৈতিকতার ধারক বা বাহক?
ইতিহাসের দিকে তাকালে এবং ধর্মের নৈতিকতার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর সব ধর্মই কিছু কিছু অমানবিক, অন্যায় ও অনৈতিক কাজকে বৈধতা দিয়ে রেখেছে। প্রচুর উদাহরণ আছে যে নীতিহীন বর্বর, অনৈতিক কাজকে ধর্মের মাধ্যমে নৈতিক বানানো হয়েছে ধর্মের আইন প্রণয়ন করে। ধর্মের আইন তৈরীই করা হয়েছে অনেক অনৈতিক কাজকে বৈধতা দেবার মাধ্যমে। এজন্যই ধর্মগুলোর মধ্যে এসব অনৈতিক এবং অন্যায়, বর্বর কাজগুলো এখনো রয়ে গেছে। যদি ধর্মই নৈতিকতার উৎস হতো এবং শুধুমাত্র ধর্মগুলোই যদি একমাত্র নেতিকতার ধারক ও বাহক হতো তবে ধর্মের মধ্যে এসব অনৈতিক, অন্যায় এবং বর্বর কাজগুলো কখনই ধর্ম বৈধতা দিতো না। ধর্মে অন্যায়, অনৈতিক এবং বর্বর কাজগুলো বৈধতা দিয়ে ধর্মই বরং অনৈতিকতার উৎস এবং অনৈতিকতার ধারক ও বাহকে পরিণত হয়েছে।
প্রাচীণকালে মানুষ বেঁচে থাকতো প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে। সেই সুত্রে মানুষের একসময় প্রয়োজন হয়েছিল মানুষের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করা। এবং আরো পরে মানুষ যুদ্ধ করেছে সম্পদের লোভে। অর্থাৎ যা ছিল মানুষের বেঁচে থাকার মাধ্যম কালক্রমে তাই হয়ে উঠেছে সম্পদ লাভের বা লোভের মতো এক অনৈতিক কাজের হাতিয়ার। প্রাচীণকালে যুদ্ধ ছিল বৈধ। সেই সাথে মানুষ খুন করাও ছিল বৈধ। জোর যার মুল্লুক তার নীতিই ছিল মানুষের প্রাচীণ নৈতিকতার উৎস। ধর্মের জন্মও সেই সময়টিতেই। ফলে ধর্মও সমাজে প্রচলিত থাকা এসব অনৈতিক বর্বর প্রথাকে বৈধতা দিয়েছে অর্থাৎ ধর্মের নৈতিকতাও তৈরী হয়েছে প্রাচীণ এসব অনৈতিক বর্বর কাজকে বৈধ করে নীতি তৈরি করার মাধ্যমে। ফলে প্রাচীণকালের বৈধ নীতিগুলো যা বর্তমানের প্রেক্ষিতে অনৈতিক এবং বর্বর এসব কাজগুলোও ধর্মের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে টিকে ছিল এবং টিকে আছে। অর্থাৎ ধর্মই এসব অনৈতিক কাজগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে এবং ধারণ ও বহন করেছে। অর্থাৎ প্রচীণকালের কিছু নৈতিক কাজ যা কালক্রমে মানুষের নৈতিকতা বোধ বৃদ্ধি ও উন্নত হবার সাথে সাথে মানুষের কাছে অনৈতিক হয়ে উঠেছে সেই সব কাজকে ধর্মই ধারণ করেছে এবং বহন করে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নিয়ে যাচ্ছে। এজন্যই মানুষ নৈতিকতায় উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে কিন্তু ধর্মগুলো সেই প্রচীন অনৈতিকই থেকে গেছে। যেমন ধর্মে বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করা বা ভিন্ন মতবলম্বীদেরকে হত্যাকরা বৈধ। কিন্তু আজ উন্নততর নৈতিকতা সম্পন্ন সমাজে যেকোন মানুষকেই হত্যা করা অন্যায়, বর্বর এবং অনৈতিক। এমনকি ভিন্ন মতামতের মানুষকে সম্মান করার মহৎ গুনগুলোও আজকের সমাজে উন্নত নৈতিকতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ধর্মগুলো এসব ক্ষেত্রে সেই প্রাচীণ বর্বরই থেকে গেছে। ফলে ধর্মের নৈতিকতা আধুনিক সামাজিক নৈতিকতা থেকে অনেক নিকৃষ্ট। এজন্যই জাতিগত দাঙ্গা বা ধর্মীয় ক্রুসেডের মতো ভয়ঙ্কর বর্বরতাগুলো আজও ঘটে চলেছে ধর্মের হাত ধরে। অর্থাৎ ধর্মই অনৈতিক থেকে গেছে এবং ধর্মের নৈতিকতা বোধই অনৈতিক থেকে গেছে। ফলে মানুষ যখন ধর্মে আচ্ছন্ন হয়ে যায় তখন সে ধর্মের এসব অনৈতিকতাগুলো দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে সে অনৈতিক মানুষ হয়ে যায়। এজন্যই ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের ধার্মিকরা পরস্পরকে ঘৃণা করে এমনকি একে অন্যকে হত্যা করার জন্য উঠে পরে লাগে। আস্তিকদের ধর্ম দ্বারা অনৈতিকতা বোধ মানুষ ভেদে ভিন্ন রকম হয়। কারণ হলো ধর্মগুলো টিকে থাকে বিশ্বাস বা অন্ধবিশ্বাসের উপর ভর করে। ফলে ধর্মের প্রতি যে বেশী নির্ভরশীল থাকে সেই ধর্মের অনৈতিকতা দ্বারা বেশী আক্রান্ত হয়। ফলে সে বেশী পরিমাণে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের ঘৃণা করে এবং তাদের হত্যার জন্য বেশী উদ্গ্রীব থাকে। এজন্যই মৌলবাদীদেরকে দেখা যায় তারা বিধর্মীদেরকে বেশী ঘৃণা করে এবং বেশী করে বিধর্মীদের প্রতি আক্রমনাত্বক হয়ে উঠে। যেমন যেসব ধার্মীক সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সাথে মেলামেশা করে, তারা স্বাভাবিক ভাবেই সব ধর্মের মানুষদের প্রতিই একই সহমর্মিতা অনুভব করে। কিন্তু যারা সব ধরণের মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায় না এবং শুধু এক ধর্মের অনুসারীদের সাথেই মেলামেশা করে থাকে তারাই ধর্মের দ্বারা বেশী আক্রান্ত হয়ে ধর্মের অনৈতিকতা দ্বারা বেশী আক্রান্ত হয়। ফলে তারাই মৌলবাদী হয়ে উঠে। এবং ভিন্ন ধর্মের মানুষদের উপর অত্যাচারী রুপে আবির্ভূত হয়।
অর্থাৎ ধর্মই মানুষকে প্রাচীণকালের নিকৃষ্ট নৈতিকতার মানুষে পরিণত করে।
বিভিন্ন ধর্মের নৈতিকতা বোধ বিভিন্ন রকম। কারণ ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। ফলে যে ধর্ম যে সময়টিতে উৎপন্ন হয়েছে সেই ধর্মটি সেই সময়ের নৈতিকতা ধারণ করেছে এবং সেই নির্দিষ্ট নৈতিকতাকেই কাল ক্রমে বহন করে চলেছে। কিন্তু কালক্রমে মানুষ উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। সেই সাথে মানুষের নৈতিকতাও উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। কিন্তু ধর্মগুলো সময়ের সাথে সাথে উন্নত হয়নি। বরং ধর্ম যেহেতু স্থবির এবং পরিবর্তনহীন তাই ধর্মের নৈতিকতা বোধও পরিবর্তনহীন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষ উন্নত হয়েছে এবং সেই সাথে তাদের নৈতিকতা বোধও উন্নত হয়েছে। আর এজন্যই দেখা যায় ধর্মই বর্তমানে প্রাচীণ অনৈতিকতাগুলোকে বহন করেছে এবং তা দ্বারা বর্তমান মানুষকে আক্রান্ত করেছে। ফলে আধুনিক সমাজে বাস করেও কিছু মানুষ সেই প্রচীণ বর্বরতাগুলো চর্চা করে চলেছে। যেমন ধর্ম যুদ্ধকে বৈধতা দিয়েছে কিন্তু আধুনিক নৈতিকতাবোধ যুদ্ধকে অনৈতিক বর্বর মনে করে। ধর্ম পশু হত্যা, নারী অবমাননাকর অনৈতিক ধারণাগুলোকে বৈধতা দিয়েছে। অথচ আধুনিক সমাজ পশু হত্যা বা নারী অবমাননাকর ধারণাগুলোকে অনৈতিক মনে করে এবং পশুহত্যাকে বর্বর প্রথা মনে করে ও নারীর সম-অধিকার দেওয়াকে মহৎ মনে করে। কিন্তু ধর্ম মতে পশুহত্যা বৈধই শুধু নয় বরং মহৎ কাজ এবং নারীর সম-অধিকার মহা পাপের কাজ। অর্থাৎ ধর্মই প্রাচীণ অমানবিক, বর্বর, মানবিকতা বহির্ভূত অনৈতিক কাজগুলোকে ধারণ করে বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। ফলে ধর্ম কখনই আধুনিক নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং অপরিবর্তনীয় ধর্মগুলো প্রাচীণ বর্বর রীতিনীতিগুলোকেও নৈতিকতার নামে বহন করেছে।
বিভিন্ন ধর্মগুলো তাদের ধর্মানুসারে বিভিন্ন রকমের নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে থাকে। খ্রিস্টানদের নৈতিকতা এবং মুসলমানদের নৈতিকতা সম্পূর্ণ এক নয়। হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিকতার সাথে খ্রিস্টান বা ইসলামের নৈতিকতারও সম্পূর্ণ মিল থাকে না। অর্থাৎ ধর্ম ভেদেও নৈতিকতা বোধের পার্থক্য দেখা যায়। এর কারণটি হলো এসব ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক পরিবেশে তৈরী হয়েছে। ফলে ধর্মের নৈতিকতা বোধেও সেই সব সময়ের এবং সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব পরেছে। যেমন হিন্দু ধর্ম অনুসারে বিধবা বিবাহ অবৈধ বা অনৈতিক ছিল। এবং এই ধর্মটির নিকৃষ্টতম বর্বরতা ছিল সতিদাহ্ প্রথাটি। এর কারণ এই ধর্ম তার নিজস্ব সময় ও সমাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ফলে ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে এই বর্বরতা ধর্মের নামে চলে এসেছে। ব্রিটিশ সরকারের শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এই ভয়ঙ্কর বর্বর, ধর্মীয় নৈতিকতার নামে প্রচলিত এই প্রথাটিকে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। হিন্দু ধর্মের এই বর্বর নৈতিকতা পরিবর্তিত হতে বাধ্য হয়েছিল বলে এই প্রথাটি বন্ধ হতে পেরেছিল। না হলে ধর্মীয় নৈতিকতার নামে এসব বর্বর কাজ আজও চলতে থাকতো। এখানে লক্ষনিয় যে ধর্মীয় বর্বর নৈতিকতা সভ্য সামাজিক নৈতিকতা দ্বারা বন্ধ হয়। অর্থাৎ ধর্মীয় নৈতিকতা আসলে মানুষই পরিবর্তন করে থাকে। যেভাবে মানুষই তাদের নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় নৈতিকতা সৃষ্টি করে ঠিক সেভাবেই মানুষই সভ্য হবার মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় ভ্রান্ত নৈতিকতাও পরিবর্তন করে থাকে। অর্থাৎ ধর্মীয় নৈতিকতা অলীক কিছু নয় বরং মানুষেরই সৃষ্টি এবং মানুষের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত। অথচ ধর্মান্ধ কিছু মানুষই আবার ধর্মীয় এসব কথিত নৈতিকতা দ্বারা মানুষকে নিয়ন্ত্রন করতে চায়।
আবার ইসলাম ধর্মে চুরির শাস্তি হাত কেটে দেওয়া বা জেনাকারীকে পাথর মেরে হত্যাকরাটা হলো ধর্মীয় নৈতিকতা। কিন্তু আধুনিক উন্নত নৈতিকতাবোধ এই কাজকে বর্বর মনে করে। মানুষকে সামান্য কারণে নির্মম ভাবে হত্যা করাটা কখনই নৈতিক হতে পারে না। জঘন্য বর্বর কাজকে যারা নৈতিক কাজ মনে করে তাদের নৈতিকতা বোধ নিকৃষ্ট। বিধর্মীদের হত্যা করা বা ধর্মত্যাগকারীকে হত্যা করা ধর্মীয় নৈতিকতায় প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু আধুনিক নৈতিকতা বোধ মানুষকে এবং মানুষের মতামত ও বিশ্বাসকে সম্মান করতে শেখায়। মানুষের স্বাধীনতা দেওয়াকে মহৎ কাজ বলে গন্য করা হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মের নৈতিকতায় এসব মহৎ কাজকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আবার এই ধর্মটি সম্পূর্ণই তৎকালীন আরবীয় নৈতিকতা বোধ দ্বারা আক্রান্ত। যেমন সেসময় বাল্য বিবাহ, শিশুকাম, কৃতদাস প্রথার মত বর্বর প্রথাগুলো বৈধ ছিল। ইসলাম ধর্মও এসব বর্বর কাজকে বৈধতা দিয়েছে। ফলে ইসলামীয় নৈতিকতা তৎকালীন আরবের সামাজিক প্রভাব দ্বারা সম্পুর্ণই আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক যুগে বাল্য বিবাহ, শিশুকাম, বা কৃতদাস প্রথা ঘৃণ্য বর্বর এবং নিকৃষ্ট অনৈতিক কাজ। অর্থাৎ ইসলামী নৈতিকতা আধুনিক নৈতিকতা বোধ থেকে নিকৃষ্ট বর্বর। অর্থাৎ আধুনিক নৈতিকতা ইসলাম ধর্মের নৈতিকতা থেকে লক্ষ গুন নৈতিক।
ফলে এটা প্রমানিত যে নৈতিকতা ধর্মের ব্যপার নয় বরং নৈতিকতা সামাজিক ব্যপার। মানুষের নৈতিকতা বোধ ধর্ম সৃষ্টি করে না বরং ধর্মের নৈতিকতাই বরং মানুষ নিয়ন্ত্রন করে। মানুষই ধর্মের নৈতিকতা সৃষ্টি করে এবং মানুষই ধর্মের অনৈতিক কাজগুলোকে সভ্য করে তুলে। আধুনিক যুগে কেউই সতিদাহ্ প্রথাকে সমর্থন করে না। আধুনিক যুগে কেউই কৃতদাস প্রথাকে সমর্থন করে না। অথচ ধর্মগুলো এসব বর্বর কাজগুলো করাকে খারাপ বলে না। বরং এসব ঘৃণ্য কাজগুলো করাই ধর্মীয় নৈতিকতার প্রধান শর্ত। পাথর ছুড়ে মারা, চুরির মতো সামান্য অপরাধে হাত কেটে নেওয়া, ধর্ম ত্যাগ করলে হত্যা করা ইত্যাদি স্বাভাবিক মানবিক কাজগুলোর জন্য নিষ্ঠুর শাস্তি দেওয়া কখনই কারো নৈতিকতা হতে পারে না। বিধর্মী হত্যা করা বা বিধর্মীদের অকারণে ঘৃণা করা কখনই কোন নৈতিকতা হতে পারে না। অথচ ধর্মগুলোর নৈতিক শিক্ষাই গড়ে উঠে এসব অনৈতিক কাজকে কেন্দ্র করে।
তাই ধর্ম কখনই নৈতিকতার উৎস, ধারক বা বাহক হতে পারে না।
কিছু কিছু নৈতিক কাজ অবশ্য সব ধর্মেই কম বেশী আছে। যেমন উপকার করা, হত্যা না করা, সদা সত্য কথা বলা, চুরি-ডাকাতি না করা, ইত্যাদি। কিন্তু এসব ভালো কাজগুলো ধর্ম সৃষ্টি হবার অনেক আগে থেকেই সমাজে প্রচলিত ছিল। বরং মানুষ যখন ধর্ম সৃষ্টি করলো তখন জনপ্রিয়তা পাবার জন্য সমাজের এসব প্রচলিত নৈতিক কাজগুলোকে ধর্মে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। ফলে পৃথিবীর সব ধর্মে হাজার হাজার পার্থক্য থাকা সত্বেও এসব নৈতিক কাজগুলো সমান ভাবে বিদ্যমান থাকে। এর কারণ হলো বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী, যে সমাজে এসব ভালো কাজগুলো প্রচলিত ছিল সেই সমাজ ব্যবস্থাই টিকে গিয়েছিল। আবার বিপরীত ভাবে যে সমাজে হত্যা, জুলুম, চুরি ডাকাতি এবং মিথ্যাবাদীতা প্রচলিত ছিল সে সমাজ এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে সব টিকে থাকা সমাজেই এসব ভালো ভালো কাজগুলো প্রচলিত ছিল।
ফলে যখন মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করলো তখন এমনিতেই মানুষকে ধর্মে নিয়ে আসার জন্য এসব ভালো কাজ করাকে ভালো বলে উল্লেখ করলো এবং খারাপ কাজগুলোকে ত্যাগ করলো। এভাবেই সমাজের কাজগুলো দ্বারা ধর্মের নৈতিকতাগুলো গঠিত হয়েছিল। এজন্য সব ধর্মেই কম বেশী ভালো কাজের আদেশ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সাথে ধর্মগুলোর উৎপত্তির সময়ে প্রচলিত কিছু বর্বর অনৈতিক কাজও ঢুকে পড়েছে যা সে সময় বৈধ এবং নৈতিক ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেসব কাজ বর্বর এবং অনৈতিক হিসেবে গন্য হয়েছে। যেমন ধর্মযুদ্ধ (জেহাদ) বা পশু হত্যার মতো নিকৃষ্ট কাজগুলো প্রাচীণ কালে টিকে থাকার প্রধান শর্ত ছিল কিন্তু আধুনিক যুগে এদুটোই ঘৃণ্য জঘন্য অনৈকিত কাজ। প্রাচীণকালে বিধর্মীদের প্রতি হিংসা, ঘৃণা এবং হত্যা করাই ছিল ধর্ম ও ধার্মিকদের টিকে থাকার প্রধান শর্ত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মানুষের নৈতিক বোধ উন্নত হবার সাথে সাথে এসব কাজ বর্বর ঘৃন্য জঘন্য অনৈতিক কাজ হিসেবে গন্য হয়েছে। আর তাই ধর্মের নৈতিকতা থেকে আধুনিক মানুষের সামাজিক নৈতিকতা অনেক অনেক নৈতিক ও মহৎ।
যেহেতু ধর্মগুলো প্রাচীণ বর্বর নৈতিকতা বোধকে নৈতিকতার প্রধান শর্ত বলে গন্য করে এবং প্রাচীণ বর্বরতাগুলো ধর্মীয় নৈতিকতার প্রধান উপাদান হিসেবে চর্চা করে থাকে তাই ধর্ম কখনই নৈতিকতার উৎস বা ধারক ও বাহক হতে পারে না। বরং মানুষই ধর্ম তৈরী করেছে বলে প্রাচীণ মানুষের বর্বরতা সম্পন্ন নৈতিকতা ধর্মের প্রধান উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে। আর তাই প্রাচীণ বর্বর অনৈতিক রীতিনীতিগুলোকে ধর্ম নৈতিক হিসেবে বর্ণনা করেছে। ফলে ধর্মান্ধরা এসব প্রাচীণ বর্বর অনৈতিক কাজগুলোকেই নৈতিকতার উৎস হিসেবে মনে করে। কিন্তু ধর্মের এসব অনৈতিক নৈতিকতার চেয়ে আধুনিক সামাজিক মানবিক নৈতিকতা লক্ষ গুন নৈতিক।
আর তাই নৈতিকতার উৎস, ধারক এবং বাহক তো ধর্ম নয়ই বরং ধর্মগুলোই অনেক অনৈতিক বর্বরতার উৎস।
এজন্য ধার্মিকরা অন্ধের মতো ধর্মাচ্ছন্ন হয়ে এসব ধর্মীয় অনৈতিকতার কাজ করে চলেছে। এজন্য মানুষ বিধর্মীদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে, ধর্মের নামে মানুষ খুন করে, নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে, পশু হত্যার মতো বর্বর উৎসব করে, ধর্মযুদ্ধের নামে হাজার হাজার মানুষের উপর অত্যাচার করে হত্যা করে। এসব জঘন্য বর্বর কাজগুলো করাকে ধর্ম ভালো বলে বৈধতা দিয়েছে। কুলশীত করেছে মানুষের মানবিক নৈতিকতাকে।
আধুনিক মানুষের নৈতিকতা বোধ ধর্মের নৈতিকতা বোধ থেকে লক্ষ গুন উৎকৃষ্ট। কারণ ধর্মগুলো প্রাচীণ মানুষের অনৈতিকতাগুলো বহন করে এবং কিছু কিছু ধর্মের নৈতিকতাগুলো ধর্ম সমাজ থেকে ধার করে নেয়।
আর তাই ধর্ম কখনই নৈতিকতার ধারক বাহক ছিল না। বরং ধর্মই অনৈতিকতার ধারক ও বাহক।
মানুষ মানবতায় যতই উৎকৃষ্ট হয়েছে ততই সমাজ থেকে অনৈতিকতা দুর হয়েছে। মানুষের জ্ঞান, মানবতাবোধ উন্নত হবার সাথে সাথেই মানুষের নৈতিকতা উন্নত থেকে উন্নততর হয়। আর তাই ধর্ম নয় বরং মানবতাবোধই নৈতিকতা নির্ধারণ করে। মানুষ যত বেশী মানবিক হয় তার নৈতিকতাবোধও তত উন্নত হয়। এজন্য প্রাচীণ মানুষের নৈতিকতাবোধে প্রাচীণ সমাজের বর্বরতার স্থান ছিল। কিন্তু যখন মানুষ সভ্য হতে শুরু করেছে তখন থেকে তার নৈতিকতাবোধও উন্নত হতে শুরু করেছে। কিন্তু ধর্মগুলো অপরিবর্তিত থাকে বলে এর নৈতিকতাও অপরিবর্তিত থেকেছে। কিন্তু মানুষের মানবিকতা বোধ বৃদ্ধির সাথে সাথে তার নৈতিকতাও উন্নত হয়েছে। আজকের সভ্য উন্নততর নৈতিকতার জন্ম হয়েছে মানুষের উন্নত মানবিকতাবোধ থেকে।
মানুষের মানবতা বোধই নৈতিকতার প্রধান উৎস এবং ধারক ও বাহক।
No comments:
Post a Comment