প্রকৃতির সব চেয়ে প্রয়োজনীয় এক নাম নারী। প্রকৃতিতে পুরুষের যতটুকু গুরুত্ব আছে নারীর গুরুত্ব তার থেকে অনেক বেশী প্রকৃতির কাছে। প্রাণী থেকে শুরু করে সভ্য মানব প্রজাতির ক্ষেত্রেও নারীর রয়েছে অভুতপূর্ণ ভূমিকা। মানুষ সহ প্রতিটি প্রাণী টিকে থাকতে পারছে শুধুমাত্র নারী প্রজাতিটির ত্যাগের জন্য। একবার চিন্তা করুনতো সৃষ্টি জগতে যদি নারীর ত্যাগ টুকু না থাকতো তা হলে কি আমি আপনি এবং সমস্ত প্রানীজগত কি টিকে থাকতে পারতাম?
জগতে নারীর অবদানকে
কখনও অস্বীকার করা যায় না। নারী না থাকলে পুরুষ
জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকতো না এই পৃথিবীতে। অর্থাৎ নারীর ত্যাগের
জন্যই আমি আপনি টিকে আছি এই জগতে। জগতে প্রাণীজগতটির
অস্তিত্ব টিকে আছে শুধু নারীর ত্যাগের জন্য। প্রাণীজগত টিকে থাকার
জন্য পুরুষের চেয়ে নারীর ত্যাগই সব চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ। মানব জাতি এবং প্রাণীজগত
টিকে আছে নারীর ত্যাগের জন্যই। সত্যি কথা বলতে কি, প্রাণীজগত ও মানব জাতি টিকে থাকে নারীর অসীম
ত্যাগের জন্যই।
মানব সভ্যতা টিকে থাকার
জন্য নারী যে ত্যাগ স্বীকার করে জগতে এর চেয়ে বড় ত্যাগ আর হয় না।
কিন্তু তবুও যুগেযুগে
নারীই হয় সবচেয়ে নিগৃহীত, নির্যাতিত।
জগতে রাজত্ব করে পুরুষ। পুরুষ শাসিত জগতে নারী
হয়ে এসেছে নির্যাতিত চিরকাল ধরে। জগতে যে নারীর ভুমিকাই
সব চেয়ে বেশী সেই নারীকেই পুরুষ জাতি করে রেখেছে শোষিত করে। পুরুষ শাসিত সমাজে
পুরুষ হলো প্রভু আর নারী হলো দাসী।
জগতে যার অবদানটির
জন্য পুরো মানব জাতি টিকে আছে, যার ত্যাগ না থাকলে
পুরুষ জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো সেই নারী জাতিকেই পুরুষরা করে রেখেছে বঞ্চিত।
মানুষ যখন গ্যালাক্সি
ছাড়িয়ে বিশ্বজগতের দিকে হাত বাড়াচ্ছে তখন আমাদের মতো দেশের মানুষগুলো পড়ে রয়েছে নারীর
সমালোচনা নিয়ে। নারীরা এভাবে পোশাক পড়ে কেন? এভাবে হাটে কেন? এভাবে থাকে কেন? এভাবে পোশাক পড়ে না কেন, এভাবে হাটে না কেন, এভাবে থাকে না কেন? এরকম হাজারটা সমালোচনা করে যাচ্ছে একটা শ্রেনী। যেখানে জগতের মানুষ
জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়টাতে কিছু মানুষ পড়ে আছে নারীর অধিকার খর্ব করে
রাখার দিকে।
কোন নারী কি করলো, কোন নারীর আচরণে ত্রুটি আছে, কোন নারী আদর্শ আর কোন নারী গোল্লায় গেলো
এই সব ব্যাপার যেন সেই সব মানুষের প্রধান চিন্তার বিষয়।
আমাদের দেশে বেশীর
ভাগ অংশই যেহেতু জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে আছে তাই এদেশেই নারী বিদ্বেষী পুরুষ মানুষ বেশী
থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অত্যত্ব দুঃখের বিষয়টা হলো যে এদেশের
শিক্ষিত শ্রেণীর বিশাল অংশের মানুষও মনে করে যে নারীকে প্রাচীণ ধ্যানধারণা মতো চলাই
উচিৎ। আধুনিকতা হলো নারী সভ্যতা ধ্বংসের একমাত্র কারণ, এমনটাই মনে করে সেই পুরুষ মানুষগুলো।
নারীর প্রতি এই বিদ্বেষমুলক
ধারনাগুলো যেমনিভাবে সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষগুলোর মধ্যে কাজ করে ঠিক একই ভাবে
সমাজের শিক্ষিত উচু শ্রেনীর মানুষদের মধ্যেও কাজ করে। অনেক তথাকথিত শিক্ষিত
মানুষকেও বলতে শুনেছি, বিয়ে করতে হলে কম বয়সী
মেয়েকে বিয়ে করাই উত্তম। তাতে সৎ বউ পাওয়া যায়। কিন্তু নিজে কতটা সৎ
সেদিকে কারো লক্ষ নেই। নিজে যেমনই হোক না কেন বউ হতে হবে সতী নারী।
সমাজের প্রত্যেকটি
লেভেলেই পুরুষের মন মানুষীকতা এরকমই। তাদের ধারণা যে মেয়ে
বাইরে যায় সে ভালো (সতী) থাকতে পারে না। যে মেয়ের অনেকগুলো
বন্ধু বান্ধব সেই মেয়েটি ভালো চরিত্রের নয়। আর যদি কোন মেয়ে কোন
ছেলের সাথে বাইরে ঘুরতে যায় তবে সেই মেয়েকে পুরুষ জাতিটি অশ্লিল ভাষায় সম্বোধন করে। তাদের মতে পার্কে যাওয়া
মেয়েটি হলো সমাজের জঘন্য মেয়েদের কাতারে। লিটনের ফ্লাটে যে মেয়ে
যায় তাকে সেই তথাকথিত শিক্ষিত পুরুষ জাতিটি কি বলে সম্বোধন করে সেটা মুখে বলার মতো
নয়।
কিন্তু খুব আশ্চর্যের
ব্যাপারটি হলো অনেক বন্ধু থাকা মেয়ে, ছেলের সাথে ঘুরতে যাওয়া
মেয়ে, পার্কে বা লিটনের ফ্লাটে
যাওয়া মেয়েটির যত অপবাদ, বদনাম, গুঞ্জন, গালাগালি সহ্য করতে হয় সেই মেয়েটির সাথে থাকা ছেলেটির কিন্তু
তার কিছুই শুনতে হয় না। কারণ সে পুরুষ শাষিত সমাজের সম্মানিত পুরুষ
জাতি। আর তাই তার জন্য সাত খুন মাফ। যে মেয়েটির অনেকগুলো
বন্ধু, যে মেয়েটি ছেলের সাথে
ঘুরতে যায়, যে মেয়েটি লিটনের ফ্লাটে
যায় সেই মেয়েটি কিন্তু একা যায় না। তার সাথে একজন ছেলেও
থাকে। কিন্তু সেই ছেলেটি পুরুষ মানুষ হওয়ায় সে মুক্ত থাকে পুরুষের
অশ্লিল বিশেষন থেকে। যত দোষ সব নন্দ ঘোষের। পুরুষের কোন দোষ
নেই।
অথচ কোন মেয়ে একা
পার্কে যায় না। সে একা লিটনের ফ্লাটে যায় না। তবুও সব দোষ তারই। কারণ সে পুরুষ শাষিত
সমাজের শোষিত শ্রেণী; সে নারী।
পার্কে যাওয়ায় অপবাদ
হয় নারীর; অথচ তার সাথে একজন
পুরুষ প্রজাতিও ছিল। লিটনের ফ্লাটে যে মেয়েটি গিয়েছিল তাকে একটি
পুরুষ প্রজাতিই নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই পুরুষের
কোন দোষ হয় না।
আমাদের সমাজে এমন তথাকথিত
শিক্ষিত মানুষও আছে যারা এসিডে দগ্ধ নারী বা ধর্ষিতা নারীকে অপবাদ দেয়। এসিড নিক্ষেপকারী বা
ধর্ষকের পক্ষে ছাফাই গায় তারা। যে মেয়ে এসিড দগ্ধ
হয়েছে বা ধর্ষিতা হয়েছি তার চালচলন, পোশাক আশাকের ব্যাপারে
কটুক্তি করা হয়। যেনো মেয়েটারই দোষ। সেই এসিড নিক্ষেপকারী
বা ধর্ষকের কোন দোষ নেই।
এটা পুরুষ শাষিত সমাজ
এখানে নারীকে পুরুষের মতো করে চলতে হবে। তার স্বাধীনভাবে চলার
অধিকার নেই। যেভাবে পুরুষ বলবে সেভাবে না চললে তাকে এসিড
মারা হবে, তার সম্মানের উপর আঘাত
হানা হবে। পুরুষের মন মতো চলো না হয় নির্যাচিত হও।
সেসব পুরুষরা এমন নিচু
মন মানষিকতা নিয়ে বাঁচে তারা কি কখনই ভেবে দেখেছে, যে মেয়েটা এসিড দগ্ধ
হলো বা ধর্ষিতা হলো সে তারই বোন হতে পারতো?
একটা মেয়ে রাস্তায় বেড়োলে যদি তাকে এসিড মারা হয়, নয়তো তার সম্মানের
উপর আঘাত হানা হয় এটা বলে যে মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হবার দরকার নেই, সে থাকবে ঘরের মধ্যে পুতুলের মতো করে, তবে সেই মানুষদেরকে কি মানুষ বলা যায়? আপনি পুরুষ হয়েছেন বলে আপনি যা ইচ্ছা তাই
করতে পারবেন আর সে নারী হয়ে জন্মেছে বলেই সে বঞ্চিত হয়ে থাকবে? কেন এমনটা হবে? আপনার যা করার অধিকার রয়েছে সেটা করার অধিকার
নারীর নেই কেন? আপনি মানুষ ওরা মানুষ
নয়? আপনাকে যদি চিড়িয়াখানায়
বন্দি করে রাখা হয় তবে কি আপনি থাকতে পারবেন?
তবে নারীদেরকে কেন থাকতে বলেন?
অনেক শিক্ষিত মানুষকে
যখন বলতে শুনি যে মেয়েদের চাকরী করার দরকার নেই, সে শুধু স্বামীর সেবা করবে, তখন ঘেন্না হয় তার উপর,
ঘেন্না হয় তার নিকৃষ্ট মন মানুষিকতার উপর, ঘেন্না হয় তার শিক্ষার
উপর।
যে জাতি নারীকে নারী
হিসেবে দেখে, মানুষ হিসেবে দেখে
না তাদেরকে আমার মানুষ বলতে ঘৃনা হয়। মানব জাতির জন্য সব
চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে নারী। তাই যদি শাসন করার
অধিকার কেউ রাখে তবে সেটা নারী হওয়া উচিত। যে পুরুষটি নারীর অধিকারকে
ক্ষুন্ন করতে চায় সে কোন এক নারীর ত্যাগেরই ফল। সুতরাং তার অধিকার
নেই নারীর অধিকারকে খর্ব করার। নারীরা হলো মা, বোন,
মেয়ে। তাই নারীর পূর্ণ অধিকার দেবার দায়িত্ব পুরুষেরই। যারা নারীর অধিকার
দেওয়াটাকে হীনমন্নতা মনে করে তারা পুরুষ নয় তারা কাপুরুষ। নারী জাতি হলো মা, বোন ও মেয়ে জাতি তাই তাদের সম্পূর্ণ অধিকার
দেবার মধ্যেই রয়েছে পুরুষত্ব। নারীর অধিকার দেবার
মাধ্যমেই প্রকৃত মানবতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
নারীরা জগতের সব চেয়ে
বড় ভুমিকা রাখে তাই শাসন করতে হলে তারাই শাসন করবে, পুরুষরা নয়। একজন পুরুষ যে অধিকার
রাখে একজন নারীও সেই অধিকার পাবে। একজন পুরুষ পার্কে
যেতে পারলে একজন নারীও পারবে পার্কে যেতে। একজন পুরুষ লিটনের
ফ্লাটে যেতে পারলে একজন নারীও সেই অধিকার রাখবে। যদি পার্কে বা লিটনের
ফ্লাটে গেলে কোন পুরুষকে বদনাম শুনতে না হয় তবে একজন নারীকেও একই অপরাধে বদনাম করা
যাবে না।
পৃথিবীতে নারী পুরুষ
মিলেই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই দুজনেরই সমান অধিকার
রয়েছে সব কিছু করার। যে পুরুষ সতী স্ত্রী পেতে চায় সে নিজেও যেন
সৎ স্বামী হয়। একজন দুশ্চরিত্র হয়ে সতী স্ত্রী চাওয়াটা ভন্ডামী। একজন পুরুষ অসৎ থেকে
সতী স্ত্রী আশা করতে পারে না। পুরুষের যেমন সতী স্ত্রী
পাওয়ার অধিকার আছে ঠিক তেমনি একজন নারীরও অধিকার রয়েছে একজন সৎ স্বামী পাওয়ার।
পুরুষের যেমন টাকা
রোজগারের অধিকার রয়েছে একজন নারীরও রয়েছে টাকা রোজগারের অধিকার। পুরুষ প্রভু নয় আর
নারীও দাসী নয়। দুজনই মানুষ; তাই দুজনেরই রয়েছে
সমান অধিকার।
পুরুষ যদি কাউকে ভালোবাসার
অধিকার রাখে তবে একজন নারীরও রয়েছে সেই ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করার। তার জন্য এসিড নিক্ষেপ
করা যাবে না। তাহলে মেয়েও এসিড মারবে পুরুষের গায়ে। সেটা যত বড় অপরাধ হবে
একটা ছেলে যদি কোন মেয়েকে এসিড মারে সেটাও হবে তত বড় অপরাধ।
ধর্ষনের শাস্তি শুধু
ধর্ষকই পাবে, ধর্ষিতা মেয়েটি নয়। তাই মেয়েটির পোশাক
এবং চালচলন নিয়ে কথা বলা যাবে না। ধর্ষক ধর্ষক হয় তার
নিকৃষ্ট মন মানুষিকতায়। কোন নারীর পোশাকে নয়।
অসুখ যার চিকিৎসা তাকেই
করতে হয়, অন্য কাউকে করলে রোগীর রোগ ভালো হয় না। তেমনি ধর্ষকের ধর্ষনের
মন মানুষিকতার জন্য ধর্ষককেই চিকিৎসা করতে হবে। ধর্ষিতাকে পোশাক পড়ালেই
ধর্ষকের মন মানুষিকতা বদলে যাবে না। রোগীকেই যেমন ঔষধ
খাওয়াতে হয় তেমনি ধর্ষককেই তার নিকৃষ্ট মন মানুষিকতা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কোন নারীকে বন্দি
করে রাখলেই ধর্ষকের ধর্ষন প্রবনতা বদলাবে না। তাই অপরাধ যে করবে
শাস্তি তাকেই পেতে হবে। রোগ যার চিকিৎসা তাকেই করতে হবে। অন্যকে নয়।
হোটেল বন্ধ রাখলেই
যেমন খিদে মিটে যায় না, চুলা বন্ধ করে রাখলেই যেমন পেট ভরে যায় না, তেমনি নারীদেরকে পোশাকে
মোড়ালেই ধর্ষকের ধর্ষন প্রবনতা বন্ধ হয়ে যায় না।
আর তাই ধর্ষকদের শাস্তি
ধর্ষককেই দিতে হবে; নির্যাচিত কোন নারীকে
নয়।
নারীকে তার প্রাপ্য
অধিকার দিতেই হবে।
সব মানুষকে শুধু তথাকথিত
সার্টিফিকেট ধারী শিক্ষিত হলেই চলবে না নিজের অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারকে
দুর করে প্রকৃত শিক্ষায় এবং আদর্শে নিজেকে উন্নত করতে হবে। তাহলেই নারীর প্রতি
পুরুষের এই দৃষ্টি ভঙ্গী বদলানো যাবে।
বি.দ্র.: গ্রন্থ মানুষকে
তৈরী করেনি, মানুষই গ্রন্থ তৈরী করেছে। ধর্ম মানুষকে তৈরি
করেনি মানুষই ধর্মকে তৈরী করেছে। কাল্পনিক সৃষ্টিকর্তা
মানুষকে সৃষ্টি করেনি, মানুষই কাল্পনিক সৃষ্টিকর্তাদের সৃষ্টি করেছে।
No comments:
Post a Comment